বাচ্চা সময় মতো পুষ্টিকর খাবারটি তৃপ্তির সাথে খেয়ে নিবে—এটা সব বাবা-মায়ের প্রত্যাশা। কত রকম কথা বলে, ছলা কলা দেখিয়েবাচ্চাকে খাওয়ানোর জন্যে তাদের প্রচেষ্টার কমতি নেই। সাধারণত বাচ্চারা অসুস্থ হলে, ক্ষুধা না থাকলে বা উপযুক্ত, উপাদেয় খাবার নাহলে খেতে চায় না। কিন্তু এর বাইরে বেশ কিছু ভ্রান্ত আচরণ ও কথা তার খাওয়ার প্রতি অনীহা সৃষ্টির জন্যে দায়ী। যা ব্যহত করে তার শরীর ও মনের সুস্থ বিকাশকে।
কী সেই কথা বা আচরণ যা আপাতদৃষ্টিতে আপনার কাছে ভালো মনে হলেও বাচ্চাকে নেতিবাচক করে তুলছে। আসুন আমরা জেনে নিই।
খাওয়া দেখলেই নানা রকম অজুহাত দেখানো কম বেশি সব বাচ্চাদের একটি কমন আচরণ। এখন খাবো না, এভাবে খাবো না, এর কাছে খাবো না, এটা খাবো না—তাদের অজুহাতের যেন শেষ নেই। এমন অবস্থায় তার খাওয়া নিয়ে জোরাজুরি না করে ছেড়ে দেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
ধৈর্য ধরুন এবং তার সাথে কৌশুলি হোন। এই যেমন তাকে অল্প খাবার দিয়ে বলতে পারেন, খেলে খাও, না খেলে পরে আর পাবে না। খাবার কিন্তু এটুকুই আছে।
আসলে আপনি বাচ্চার খাবারের ব্যাপারে আগ্রহ যত কম দেখাবেন তত তার খাবারের আগ্রহ বাড়বে। কারণ যা এমনিই পাওয়া যায়, সেটার প্রতি কারো আগ্রহ থাকে না। ক্ষুধা যখন লাগবে তখন বাচ্চা পেটের দায়ে নিজেই খাবে। এছাড়া খাবার নিয়ে বাচ্চার সামনে বসে তার দিকে তাকিয়ে বলতে পারেন, ঠিক আছে তুমি তো খাবে না, আমি খাচ্ছি। এই বলে আপনার মুখে এক লোকমা তুলে দেবেন। এরপর আরেক লোকমা। তারপর আরেক। দেখবেন খাওয়ার ব্যাপারে তার আগ্রহ হচ্ছে। এমনও হতে পারে সে আপনার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে খেতে শুরু দিয়েছে। কারণ তারও তো ক্ষুধা আছে। আর খাবার দেখলে ক্ষুধা আরো বেশি লাগে। বরং তখন মারধর, বকাঝকা, জোরাজুরি এমন আচরণের জন্যে হিতে বিপরীত ঘটে।
আপনার আচরণ কিন্তু বাচ্চার একদিনের খাওয়াকে নয় বরং এটি প্রভাব ফেলবে তার ২০ বছর পরের খাদ্যাভাসের উপরেও। ১০০ জন কলেজ শিক্ষার্থীর উপর ‘খাওয়ার রুচি’ নিয়ে একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে তাদের ৭০%কে ছোটবেলায় জোর করে খাওয়ানো হতো। এদের ৩১% সাথে ভীষণ জোর করা হতো, ৪১% মাঝারি এবং ২৯% এর সাথে অল্প জোর।
তাদের বর্ণিত অভিজ্ঞতা অনুসারে, ঐ সময় ৪৯% কান্না করত, ৫৫% খাবারের প্রতি বেশ বিরক্ত হতো যা সৃষ্টি করত বমি বমি ভাব। আর ঐ অবস্থায় অবশেষে বমি করে দিত ২০%। পরবর্তীতে এই পরিস্থিতি তাদের মধ্যে রাগ, ক্ষোভ, ভয়, ঘৃণা, দ্বিধা বিভিন্ন নেতিবাচক আচরণের জন্ম দেয়। যা এক রকম অসহায়ত্ব এবং আত্মনিয়ন্ত্রণহীনতা বোধ সৃষ্টির জন্যেও দায়ী।
ছোটবেলার এই ঘটনাগুলো বড় হতে হতে পুরোপুরি পালটে দেয় তার খাদ্যাভাসকে। জরিপে অংশগ্রহণকারী এক তৃতীয়াংশ ছেলে মেয়ে এর সাথে একমত পোষণ করেন। তাদের মধ্যে ৭৩% এর খাবারের প্রতি খুব অনীহা এবং ২৭% এ নতুন খাবারের প্রতি আগ্রহ বোধ করেন বলে জানান।
এই অনীহা যেমন অপুষ্টিহীনতায় ভোগাচ্ছে অনেককে, অপরদিকে অতিরিক্ত আগ্রহী হয়ে স্থূলকায় হওয়া মানুষের সংখ্যাও কম নয়। আসলে খাবার গ্রহণের সাথে নির্ভর করছে ব্যক্তির স্বাদ, ক্ষুধা, মুড, শ্রবণ, শারীরিক গঠন এবং বিশ্বাস। নিজেকে দিয়ে বিচার করলেই স্পষ্ট বুঝা যায় বিষয়টি।
আপনার বাচ্চার পেছনে হয়তো সারাদিন খাবার নিয়ে ছুটাছটি করতে হয়। খাবার মুখে নিতে চায় না। নিলেও ঠোটেঁ আটকে রাখে। চাবায়ও না, গিলেও না। আর এর মধ্যে বাচ্চার এই না খাওয়ার বিষয়টি আপনি হয়তো শেয়ার করে ফেলেছেন পরিচিতদের সাথে।
অথবা আপনি হয়তো বাচ্চাকে বলেছেন, দেখেছ ও কত সুন্দর খেয়ে নিচ্ছে। তুমি যে খাচ্ছো না, তুমি তো পঁচা বাবু।
মনে রাখবেন শিশুদের আত্মসম্মানবোধ খুব প্রবল হয়। আপনার এমন আচরণের জন্যে সে মনে করে, তার আর প্রেস্টিজ বলে কিছু থাকল না। তাই প্রেস্টিজ যখন নেই এবং সেটা বজায় রাখার আর প্রয়োজন মনে করে না সে। এই অপমান তার মনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এবং ধীরে ধীরে তাকে করে তুলে বিদ্রোহী এবং হীনমন্ন।
তাই এখন থেকে সবাইকে বলুন, আমার বাচ্চা খুব ভালো। ও অন্যদের মতো না। খাবার দিলেই ও খেয়ে ফেলে।
বাচ্চা যখন ঘুমাবে তখন তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলতে পারেন, তুমি খুব ভালো, খাবার দিলে খেয়ে ফেলো। কারণে ঘুমালে পরে একটি ইন্দ্রিয় সজাগ থাকে। সেটা হচ্ছে কান। তাই এই মেসেজটা সে যত শুনবে, তার ব্রেনে কাজ করবে এবং অবচেতন থেকেই খাওয়ার প্রতি তার আগ্রহ বাড়বে। অর্থাৎ যা আপনি তাকে দিয়ে করাতে চাচ্ছেন এই মেসেজটা তাকে বার বার দিবেন।
দেখবেন কিছুদিন পর আপনার বাচ্চা যেমন খেতে শুরু করেছে তেমনি সবার কাছে গিয়ে বলছে-জানো, আমি খুব ভালো বেবি। খাবার দিলে খেয়ে ফেলি।
বর্তমানে অধিকাংশ পরিবারে বাচ্চারা বড় হচ্ছে খুব একাভাবে। এর দুটো কারণ। একটি হলো কর্মজীবি বাবা-মা যারা বাচ্চাকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না, আরেকটি হলো ভাই-বোনহীন, আত্মীয়হীন ছোট পরিবার।
দেখা গেছে এমন বাচ্চারা খাওয়ার সময় ছুটাছুটি করেও বেশি। আসলে মাকে এভাবে বিরক্ত করে মজা পায় বাচ্চারা। তার কাছে এটা মাকে কাছে পাওয়ার একটা বাহানা। কারণ ছোট হলেও বুঝে যে, সে যদি ভোলাভালার মতো খেয়ে নেয় তবে খাওয়ানো শেষ করে মা ব্যস্ত হয়ে পড়বে অন্য কাজে। কিন্তু না খেলে সে ততক্ষণ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারবে মায়ের মনোযোগকে। তাই যে বাচ্চা শুধুমাত্র আপনার মনোযোগ পাবার প্রত্যাশায় না খেয়ে থাকছে, তার দিকে পরিপূর্ণ মনোযোগ দেয়ার বিষয়টি খেয়াল রাখুন।
‘খাও, নয়তো কালো বিড়াল আসবে আর ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে তোমার খাবার ঐ যে ভুত আসলো তোমাকে কামড় দিতে’- বাচ্চারা খেতে না চাইলে পাড়ার কালো বিড়াল, মামদু ভুতের মতো অবাস্তব বিভিন্ন জিনিস নিয়ে এহেন কথাবার্তা আমরা বলে থাকি কমবেশি সবাই।
ঘটনার প্রেক্ষিতে বাচ্চা হয়তো তাৎক্ষণিক খেয়ে নেয়। কিন্তু এজন্যে বাচ্চার ওপর যে শারীরিক এবং মানসিক দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়ে—সেটা নিয়ে কী কখনো ভেবেছেন? আর এই ভয়ের সঞ্চার যে আপনার মধ্যেও হবে না তা কিন্তু নিশ্চিত বলা যায় না। আসলে বাচ্চারা কিন্তু অনেক কিছুই প্রকাশ করতে পারে না। পরবর্তীতে এই ভয়ই তার মনে জন্ম দেয় অহেতুক ভয়ের। আর ভয় পেয়ে খেয়ে একসময় খাবারের প্রতি সৃষ্টি হবে অরুচি অথবা আসক্তি। যা ব্যহত করবে তার পরিপূর্ণ শারীরিক ও মানসিক বিকাশ। তাই খাওয়ার সময় ভয় দেখিয়ে নয় বরং মজার গল্প বলে বা তার প্রিয় খেলনা দিয়ে খেলে সেই সময়টা আনন্দে ভরিয়ে তুলুন।
অনাগত সন্তানের শারীরিক ও মানসিক পরিপূর্ণ বিকাশের জন্যে একজন সন্তানসম্ভবা মায়ের গর্ভাবস্থার খাদ্যাভাসের বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এসময় যে মায়েরা পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার সুযোগ পান নি বা অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়েছেন—তাদের সন্তানদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মানসিক সমস্যা যেমন হতাশা, খিট খিটে ভাব, খাওয়ার প্রতি অনীহা।
আসলে অপুষ্টির ফলে এই বাচ্চাদের ব্রেন বা নার্ভাস সিস্টেমের যে দুর্বলতা, সেটা কাটিয়ে উঠার জন্যে মেডিটেশন এবং অটোসাজেশন খুব কার্যকরী। এ দুটি তার মধ্যে সৃষ্টি করবে পজিটিভ শক্তি। যা দিয়ে সে অতিক্রম করতে পারবে শারীরিক সীমাবদ্ধতাকেও। আসলে প্রতিটি মানুষের মধ্যেই রয়েছে অফুরন্ত পুনরুজ্জীবনী ক্ষমতা। মস্তিষ্কের সংযোগায়ন বাড়ালেই এই পুনরুজ্জীবনী ক্ষমতাও বাড়ে এবং তার সুষ্ঠ বিকাশে সাহায্য করে।
এই সময়ে বাচ্চাদের খাওয়ানো রিতিমতো পরীক্ষায় অংশ গ্রহনের মতো কাজ। সেক্ষেত্রে আপনি পরীক্ষায় পাশ করবেন এমনও না। তাই আগে থেকে চার্ট করে নেওয়া ভালো, যাতে করে সর্বোত্তম মার্ক্স না পেলেও পাশ করতে পারেন। আসুন তাহলে যেনে নেই কিভাবে বাচ্চার সাথে যুদ্ধ ছাড়াই খেতে উৎসাহিত করা যায়।